IQNA

ড. মোহাম্মদ হাননান 

ধর্মীয় শিক্ষালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয়  

20:35 - February 21, 2022
সংবাদ: 3471460
তেহরান (ইকনা): গত মাসে বাংলা একাডেমি বইমেলা থেকে শিশির ভট্টাচার্য্যের ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস আদিপর্ব’ বইখানা কিনেছিলাম। কোনো বই পড়ার আগে আদ্যোপান্ত পাতা ওল্টানো আমার অভ্যাস। চোখ পড়ল ২৭৭ পৃষ্ঠায়, লেখক দুনিয়ায় প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ইতিহাসের কয়েকটি অভিমত তুলে ধরেছেন। এর মধ্যে একটি অভিমত হচ্ছে,

...খ্রিস্টপূর্ব যুগের উত্তর ভারতের (বর্তমানে পাকিস্তানের) তক্ষশীলা, পূর্ব ভারতের বিহারের নালন্দা বা মিসরের আল আজহার মাদরাসা একসময় বিশ্ববিদ্যালয় ছিল—এ মত দাবি অনেকে নিরঙ্কুশভাবে মেনে না-ও নিতে পারেন।
 
 
...১০ম শতাব্দী থেকেই মধ্যযুগের কিছু মাদরাসা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হয়েছিল। ...মধ্যযুগে মধ্যপ্রাচ্যের মাদরাসা ও মধ্যযুগে ইউরোপের বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে মিল আছে। সুতরাং মাদরাসা থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভব। এই মতের অনুসারীরা দাবি করেন, আন্দালুসিয়া, সিসিলি আমিরাত এবং মধ্যপ্রাচ্যের... মাদরাসাগুলোর অনুকরণে সৃষ্টি হয়েছিল মধ্যযুগের প্রথম দিকের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। শিশির ভট্টাচার্য্য : বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস আদিপর্ব, প্রথমা, ঢাকা, ২০১৮, পৃষ্ঠা [২৭৭-২৭৮]।
 
আরেকজন শিশির আছেন, তিনি শিশির কুমার দাশ, তাঁর লেখা ‘মোদের গরব মোদের আশা’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘ইউরোপের ছাপাখানার বড় পৃষ্ঠপোষক ছিল চার্চ এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। প্রকৃতপক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো চার্চেরই সন্তান। [শিশির কুমার দাশ : মোদের গরব মোদের আশা, বিপিএল, ঢাকা, ২০১৮, পৃষ্ঠা ৮৬]।
 
দুই লেখকের মধ্যে একটা মিল পাচ্ছি। মিলটি হলো, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রতিষ্ঠার পেছনে রয়েছে ধর্মীয় শিক্ষা। চার্চে লেখাপড়া শেখানো হতো কি না, সে তথ্য আমার জানা নেই। তবে মসজিদ ও মাদরাসা ইবাদত ও লেখাপড়ায় একাকার। প্রাথমিক যুগে যেমন, তেমনি এখনো মসজিদ-মাদরাসাগুলো জ্ঞান শিক্ষারই আলয়। বিশেষ করে কওমি মাদরাসার ইফতা, তাফসির ও হাদিসশাস্ত্র অধ্যয়নের যে মানদণ্ড তা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাসের সমপর্যায়ভুক্ত লেখাপড়া। নামে ‘মাদরাসা’ শব্দ থাকলে কী হবে, আজকের ‘দেওবন্দ’ উঁচুমানের বিশ্ববিদ্যালয়। বাংলাদেশে হাটহাজারীসহ আরো অনেক কওমি মাদরাসা আছে, যা এ মর্যাদায় অভিষিক্ত।
 
আমার স্ত্রী ড. আরজুমন্দ আরা বানু বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ান। তিনি আমার এটুকু লিপি দেখলেন এবং বললেন, “প্রাচীন ও মধ্যযুগে লেখাপড়ার জন্য যে টোলব্যবস্থা প্রচলিত ছিল, তা ছিল ‘আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাথমিক ভিত্তি। ’ টোলে ছাত্ররা যেত গুরুর কাছে, যার যার খাবার তারা নিয়ে যেত, সারা দিন সেখানেই থাকত। লেখাপড়া শেষে বাড়িতে ফিরত। আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘আবাসিক’ ধারণাটি এভাবেই এসেছে। গোড়াতে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় আবাসিক ছিল না; কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রথম থেকেই আবাসিক। এ অঞ্চলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ই প্রথম আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়। ”
 
কথাটি আমার মনে লাগল। আমি দেখেছি, কওমি মাদরাসার স্টাইলটিও এ রকম। প্রধানভাবে আবাসিক। মাদরাসার কাছাকাছি যাদের বাসাবাড়ি, তারা খাবার নিয়ে পড়তে আসে ওস্তাদের কাছে। যারা রাতে থেকে যায়, মাদরাসায় তাদের খাবারের ব্যবস্থা হয় অভিভাবকদের থেকে। প্রথম শ্রেণি নাজেরা থেকে সর্বশেষ ধাপ ইফতা অথবা তাফসির কিংবা হাদিসশাস্ত্র মুসাবিদা পর্যন্ত মাদরাসা শিক্ষা প্রধানভাবে আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়েরই মর্যাদায়।
 
মাদরাসা শিক্ষা সম্পর্কে আমাদের অবজ্ঞা, নেতিবাচক ধারণাটি আমরা পেয়েছি খ্রিস্টানদের থেকে। ১৭৫৭ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত এ দেশে ব্রিটিশ-ইংরেজের ছদ্মাবরণে প্রকৃতপক্ষে চলেছে খ্রিস্টীয় শাসন। কওমি মাদরাসাকে ধ্বংস করতে খ্রিস্টানরা এ দেশে চালু করেছিল আলিয়া মাদরাসা। প্রতিষ্ঠার পর থেকে আলিয়া মাদরাসার অধ্যক্ষ পদে পরপর ৩০ জন অধ্যক্ষ ছিল খ্রিস্টান পাদরি অথবা যাজক। কলকাতা আলিয়া মাদরাসায় বুখারি শরিফ পড়াতেন খ্রিস্টান পাদরিরা। আর এর মাধ্যমে মুসলিমদের মধ্যে একটা ‘বুখারি গ্রুপ’ তারা তৈরি করে ফেলে, যারা বুখারি ছাড়া আর কোনো হাদিসের অস্তিত্ব স্বীকার করে না। এভাবে মাদরাসা শিক্ষায় তারা একটা বিভক্তি এনে দেয়, যার প্রভাব বর্তমান সময়েও অস্থিরতা সৃষ্টি করে চলেছে। জঙ্গি একজন ধরা পড়লে কিংবা কোনো অপ্রীতিকর সংবাদের সঙ্গে ‘মাদরাসা পড়ুয়া’ জানলেই গণমাধ্যমগুলোও হা হা করে ওঠে, অথচ কেউ অনুসন্ধান করে দেখে না, এরা কোন প্রকৃতির মাদরাসার ছাত্র, মুসলিমসমাজের মধ্যে এটা একটা দৈন্য, যা মস্তিষ্কের গভীরে প্রোথিত হয়ে গেছে। অথচ মাদরাসাগুলো আজকের দুনিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় ধারণার সূত্রপাত করেছিল, যা এখনো অক্ষুণ্ন আছে।
 
লেখক : ইতিহাস গবেষক
captcha